
প্রকাশিত: Sat, Jan 21, 2023 3:09 PM আপডেট: Sat, Jun 28, 2025 6:43 AM
প্রসঙ্গ ‘বিউটি সার্কাস’!
রেজা ঘটক
নির্মাতা মাহমুদ দিদারের চলচ্চিত্র ‘বিউটি সার্কাস’ আগেই দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নিজের কাজের ব্যস্ততায় সেই সুযোগ হয়নি। এবার ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বিউটি সার্কাস’ দেখার সুযোগ পেলাম। আবহমান বাংলার বৈচিত্রময় জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে আমার ছোটবেলা থেকেই অনেক কৌতূহল। ১৯৮৬ সালে আমাদের এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের এলাকায় লক্ষণ দাসের সার্কাস চলছিল। পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে আমরা সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম। আহা সেকি আনন্দ!
সার্কাস নিয়ে একটা মজার সিনেমা আছে ‘টু ব্রাদার্স’। ফরাসি নির্মাতা জ্যঁ জ্যাকুইস আনাউদ দুই জমজ বাঘ (কুমাল ও সাংহা) কে নিয়ে ‘টু ব্রাদার্স’ নামে যে ছবি নির্মাণ করেছেন, তা সত্যি সত্যি দেখার মত এক সিনেমা। সেখানে দুই জমজ বাঘের একটি বাঘ সার্কাস টিমে বড় হয়। অসাধারণ এক সিনেমা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর ‘টোপ’ (২০১৭) ছবিতেও সার্কাসের ঘটনাবলী ব্যবহার করেছেন। সার্কাস এমনিতেই একটা বড় ধরনের বিনোদন। সেখানে সার্কাস নিয়ে সিনেমা বানালে সেটি আরো আকর্ষণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু ‘বিউটি সার্কাস’ কেন আমাদের মিডিয়ায় খুব একটা প্রচার পেলো না? আবার দর্শক কেন ‘বিউটি সার্কাস’ দেখার জন্য সেভাবে সিনেমাহলে লাইন দিল না? এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই হয়তো ‘বিউটি সার্কাস’-এর অন্তরালের ব্যাপারটি বোঝা যাবে। যেটা আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে অনেকটাই রাজনৈতিক। অথচ ‘বিউটি সার্কাস’ কিন্তু তারকাবহুল চলচ্চিত্র।
ছবিতে বিউটি (জয়া আহসান) তার বাবার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য ‘বিউটি সার্কাস’ নামে একটি সার্কাসের দল পরিচালনা করেন। যেখানে বিউটি ইজ দ্য কুইন অব দ্যাট সার্কাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সহায়তা করার জন্য এবং পাকিস্তানিদের সমাবেশে যোগদান না করার জন্য বিউটির বাবাকে (যিনি তখন বেঙ্গল সার্কাস পরিচালনা করতেন) পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার-আলবদররা খুন করে। পিতৃহত্যার বদলা নিতেই বিউটি দীর্ঘদিন ধরে বানিয়া শান্তায় রাজাকার নাদের মোল্লাকে খুঁজতে থাকে। আর হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়।
বানিয়া শান্তায় সার্কাস চলাকালীন বিউটিকে এলাকার তিন জন প্রভাবশালী ব্যক্তি পছন্দ করেন এবং প্রত্যেকেই বিউটকে নিজের প্রেয়সী ভাবতে শুরু করেন। তারা হলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান নবাব (তৌকির আহমেদ), স্থানীয় জমিদার মির্জা মোহাম্মদ বখতিয়ার (ফেরদৌস আহমেদ) ও স্থানীয় যুবনেতা রঙ্গলাল (এবিএম সুমন)। কিন্তু বিউটি কৌশলে এদের প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে আলাদা রেখে বাবার হত্যাকারী নাদের মোল্লাকে (গাজী রাকায়েত) খুঁজতে থাকেন। এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার বাইরে বিউটকে ফেস করতে হয় মৌলবাদের চরম হুমকি। শেষ পর্যন্ত সংগ্রামী নারী বিউটির বিজয় দিয়ে সিনেমা শেষ হয়। গল্পটি এককথায় দুর্দান্ত। কিন্তু ছবিতে সার্কাসের আড়ালে মৌলবাদ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রতিযোগিতাকে মোকাবেলা করতে বিউটিকে বেশ কৌশলী হতে হয়। যা সিনেমায় চিত্রায়ন করা হয়।
সিনেমায় ব্যবহৃত তিনটি গানই দুর্দান্ত। একটি গান গেয়েছেন চিরকুট ব্যান্ডের ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমী, একটি গান গেয়েছেন অ্যাশেজ ব্যান্ডের ইভান এবং একটি গান গেয়েছেন টুনটুন বাউল। সিনেমায় ভিএফএক্স এর ব্যবহার নজর কাড়ার মত। খোলা আকাশের নিচে সার্কাস সেট তৈরি করে সেখানে শ্যুট করতে নির্মাতা মাহমুদ দিদারকে এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি ‘বিউটি সার্কাস’ নির্মাণ করতে নির্মাতা যে পরিশ্রম করেছেন, ইমপ্রেস হয়তো সিনেমাটির প্রোমোশনকে ততোটা গুরুত্ব দেয়নি। অথবা আমাদের গণমাধ্যম অজানা কোনো কারণে ‘বিউটি সার্কাস’কে ততখানি প্রচারও করেনি। ফলে দর্শক একটি সুন্দর বাংলা ছবি দেখার সুযোগ থেকে প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত হয়েছে।
‘বিউটি সার্কাস’ সিনেমায় জয়া আহসানকে নিসন্দেহে প্রচুর পরিশ্রম করে সার্কাসের বিষয়-আশয় রপ্ত করতে হয়েছে। রশির উপর দিয়ে হাঁটা, চাকু চালানো, রিং কিংবা রশির সাহায্যে মঞ্চে নামা প্রতিটি ধাপই অনেক কঠিন কঠিন সার্কাসের বিষয়। জয়া আহসান সার্কাসের সেই খেলাগুলো দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। দেখলে একবারও মনে হবে না যে বিউটি মোটেও সার্কাসের মেয়ে নয়! হুমায়ুন সাধু, তৌকির আহমেদ, এবিএম সুমন, গাজী রাকায়েত এমনকি ফেরদৌস আহমেদও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সার্কাসের রিয়েল ফিলিংসটা পুরোপুরি ছিল। সার্কাসের আড়ালে বিউটির বাবা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অংশটায় নির্মাতাকে হয়তো কিছুটা আপোষ করতে হয়েছে। কারণ এটি একটি বিগ অ্যারেঞ্জমেন্ট সিনেমা। কিন্তু সিনেমার যে নির্মল বিনোদন, সেটি সংলাপ থেকে শুরু করে, সংগীতায়োজন, সেট, অভিনয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এককথায় দুর্দান্ত।
একটি ভালো সিনেমা কেন বাংলাদেশের দর্শকরা সিনেমাহলে লাইন দিয়ে দেখলো না, কেন সিনেমাটি কয়েক মাস সিনেমাহলে স্থায়ী হলো না, সেই কারণ অনুসন্ধান করলেই আমাদের সিনেমারুচি ও সমাজ কাঠামোর বর্তমান তলানিদশা বেশ ভালোমতই টের পাওয়া যায়। সিনেমায় কাদের মোল্লা (শতাব্দী ওয়াদুদ)-র একটা সংলাপ ছিল এরকমÑ ‘আমার কোনো ধর্ম নাই, টাকাই আমার ধর্ম’। বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের সমাজের শিকরে যে পচন ধরেছে, একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদী শক্তি যেভাবে সমাজের ভেতরটা পুরোপুরি দখল করেছে, তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কেন ‘বিউটি সার্কাস’ ব্যবসাসফল সিনেমা হলো না! নির্মাতা মাহমুদ দিদার ও বিউটি সার্কাস টিমকে অভিনন্দন। যতই প্রতিকূলতা থাকুক না কেন বাংলা সিনেমা ধীরে ধীরে আবার স্বর্ণযুগের দিকে হাঁটা শুরু করেছে, এটাই একমাত্র আনন্দের বিষয়। লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
